কামাল উদ্দিন উখিয়া
মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার বৃদ্ধ হাকিম আলী (৫০) জানেন না তার স্ত্রী, ৫ ছেলে ও ২ কন্যার খবর। টানা চেষ্টার পর গত ৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমার থেকে ট্রলারযোগে নাফ নদীর সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফের নয়াপাড়ার ২৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই ব্লকের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। একটি দালাল চক্রের হাতে মিয়ানমারের মুদ্রা ৫ লাখ কিয়ান দেওয়ার পর তাকে মিয়ানমারের প্যারাংপুরু এলাকায় নৌকায় ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়। ওই নৌকায় ওইদিন তার সাথে ১০ জন এসেছেন। গত রোববার টেকনাফের নয়াপাড়ার ২৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলাপকালে এসব তথ্য জানান হাকিম আলী। ওই ক্যাম্পে গত এক সপ্তাহে নতুন করে আসা অন্তত ৩শ রোহিঙ্গা রয়েছে।
হাকিম আলী জানান, মিয়ানমারের জান্তা ও আরাকান আর্মির লড়াইয়ে তার বাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পর স্ত্রী ও সন্তানদের খবর জানেন না। তিনি মংডুর কাছাকাছি এলে আরাকান আর্মির সদস্যরা তাকে আটকে রাখে। তাদের ক্যাম্পে নির্যাতন করে নানা বিষয় জিজ্ঞাসা করা হয়। ক্যাম্পে তিনি টানা ৩ মাস ছিলেন। তাকে ছেড়ে দেওয়ার পর ১০–১২ দিন চেষ্টা করে ক্যাম্পের এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় টেকনাফের এক দালালের সাথে আলাপ করেন। ওই দালালের দেওয়া তথ্য মতে প্যারাংপুরু এলাকায় নাফ নদীর প্যারাবনে অবস্থান নেন। নৌকা নিয়ে দালালরা যাওয়ার পর মিয়ানমারের ৫ লাখ কিয়ান দিলে নৌকায় তুলে এপারে নিয়ে আসে। এরপর লুকিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছেন।
হাকিম আলীর ৭ ছেলেমেয়ে জীবিত থাকলেও স্ত্রী বোমার আঘাতে মারা গেছেন বলেন শুনেছেন। ওখানে দুই পক্ষের সংঘাতে অনেকে হতাহত হচ্ছে। রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে এদিক–ওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশিরভাগই সীমান্তে জড়ো হয়েছে। এরাও বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চায়।
একই ক্যাম্পে আলাপ হয় মংডু শহরের নিকটবর্তী এলাকার বৃদ্ধা রাহানুমা আকতারের (৫২) সাথে। তিনিও ৫ লাখ কিয়ান দেওয়ার পর দালালের সহায়তায় ৪ দিন আগে টেকনাফ পৌঁছেন। তিনি জানান, ২০১৭ সালে তার ছেলে বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি স্বামীসহ বাড়িতে থাকলেও সংঘর্ষের সময় তার বাড়ি পুড়ে যায়। স্বামী কোথায় আছেন জানেন না। পালিয়ে ছেলের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। ওই ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ৩শ রোহিঙ্গার মধ্যে ৩০–৩২ জন রোহিঙ্গা স্বীকার করেছেন, মিয়ানমারের সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ কিয়ান দেওয়ার পর দালালরা নৌকায় তুলে তাদের টেকনাফ নিয়ে আসছে।
নয়াপাড়া ২৬ নং ক্যাম্পের ই ব্লকের কমিউনিটি নেতা (মাঝি) নুরুল আলম নতুন রোহিঙ্গা আসার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা তাদের আত্মীয়স্বজনের শেডে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো তাদের তালিকা হচ্ছে না বা খোঁজা হচ্ছে না।
গত রোববার বিকালে উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে নতুন আসা রোহিঙ্গা হাবিব উল্লাহর সাথে কথা হয়। তিনিও সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। তারা আসার আগে তার বাবাকে হত্যা করেছে আরাকান আর্মি। তিনি জানান, তার বাবাকে হত্যার পর তারা প্রাণ বাঁচাতে নৌকা নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। মংডুর উত্তরের একটি গ্রামে তার বাড়ি, সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। একের পর এক বোমা নিক্ষেপের কারণে এলাকার চিত্র পর্যন্ত পাল্টে যাচ্ছে। প্যারাংপুরাসহ নাফ নদীর পাড়ের বেশ কিছু গ্রামে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় আছে।
এর আগে শুক্রবার ভোরে টেকনাফের একটি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবারের সাথে আলাপ হয়। টেকনাফের একটি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করা রোহিঙ্গা পরিবারের অনেক সদস্য কান্না করছিলেন। তারা বলেছেন, মংডু শহরের দলিয়াপাড়া ও সুদাপাড়া এলাকা এখন রোহিঙ্গাশূন্য। ওখানে উভয় পক্ষ শক্তিশালী গ্রেনেড, বোমা, মর্টার শেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তাতে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। প্রাণ রক্ষায় যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। দালালদের জনপ্রতি বাংলাদেশি ২০ হাজার টাকা দিয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। এখন ক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। ওইসব রোহিঙ্গা বলছেন, লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা সীমান্ত জড়ো হয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশি ১ টাকায় মিয়ানমারের মুদ্রায় ১৭ কিয়ানের বেশি। ওই হিসেব মতে জনপ্রতি ২০–২৫ হাজার টাকায় দালালরা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে।
আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ডা. জুবায়ের বলেন, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ক্রাইসিসকে গুরুত্ব না দেওয়ায় আজকের দিনের এই চিত্র দেখতে হচ্ছে। মূলত আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর লড়াই দেখিয়ে রোহিঙ্গা নির্মূল করা হচ্ছে। সে কারণে নিরস্ত্র, নিরীহ রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে এদেশে ছুটে আসছে। এতে সমস্যা আরো জটিল হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বোঝা সহ্য করে যাচ্ছে। নতুন করে রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত না হয় সেজন্য এখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আওয়াজ তুলতে হবে।
আরাকান রোহিঙ্গা ইয়ুথ কোয়ালিশনের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, বর্তমানে গণহত্যার দ্বিতীয় পর্ব চলছে। এবারের গণহত্যা ২০১৭ সালের চেয়েও ভয়াবহ। যেসব এলাকায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসতি আছে সেসব এলাকায় আরাকান আর্মি ঘাঁটি করে যুদ্ধ করছে, যাতে করে রোহিঙ্গারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে তীব্র সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। একই সঙ্গে জান্তা বাহিনী শেষ পর্যন্ত ওই শহরটির দখল রাখতে প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে। এর জের ধরে গত সপ্তাহ ধরে আকাশ পথে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের তীব্র লড়াইয়ের কারণে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কাঁপছে টেকনাফের সীমান্ত এলাকা। এতে টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ আতংকের মধ্যে অন্তত ৩০ পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য মিলেছে। গত এক মাসে এসব পয়েন্ট দিয়ে কমপক্ষে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে ধারণা করছে সীমান্তের মানুষ।
Leave a Reply